0

হাদিসের নির্দেশনা
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদিসসমূহ পিতামাতার প্রতি আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে আরও অধিক সবিস্তার বিবরণ প্রদান করে। তা পিতামাতার অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে পুরষ্কার এবং তাদের অবাধ্য হলে শাস্তির বর্ণনাও প্রদান করে। নিচে কিছু সংশ্লিষ্ট হাদিস পেশ করা হল:

পিতামাতার আনুগত্যের গুরুত্ব

হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) হতে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম.কে কবীরা গুনাহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি উত্তরে বলেন, তা হল- আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করা, পিতামাতার অবাধ্য হওয়া, তাদের সাথে অসদাচারণ করা কিংবা তাদের আঘাত দেওয়া, অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া। (বুখারি)

হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রা.) বলেন, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কোন আমল বা কাজ আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয়? তিনি উত্তরে বলেন, সময়মত নামাজ আদায় করা। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এরপরে কি? তিনি উত্তর করলেন, পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করা। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, অত:পর কি? তিনি উত্তর করলেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা। (বুখারি, মুসলিম)

হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আছ (রা.) বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে আগমন করল এবং বলল, আমি আপনার কাছে হিজরত ও আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের বায়আত হতে এসেছি। তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানতে চাইলেন, তার পিতামাতা বেঁচে আছে কিনা। লোকটি উত্তর করল, হ্যঁা, উভয়েই বেঁচে আছেন। তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, তোমার পিতামাতার কাছে ফিরে যাও এবং তাদের সেবা কর। (বুখারি, মুসলিম)

এই হাদিসের উপর ভিত্তি করে ওলামায়ে কেরাম বলেন, যদি ফরজে আইন না হয় তবে পিতামাতার অনুমতি ব্যতিত জিহাদ কিংবা দীন শিক্ষা করার জন্য নিজ শহরের বাইরে যাওয়া যাবে না। নিম্নলিখিত হাদিসটিও একই বিষয় ব্যক্ত করে:

হজরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি জিহাদের উদ্দেশ্যে ইয়ামেন থেকে মদীনায় হিজরত করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়ামেনে তার কোন আত্মীয়-স্বজন আছে কিনা? লোকটি উত্তর করল, সেখানে তার পিতামাতা রয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন যে, সে তার পিতামাতার অনুমতি নিয়ে এসেছে কিনা? লোকটি উত্তর করল, না। তখন তিনি তাকে বললেন, তুমি তোমার পিতামাতার কাছে ফিরে যাও। হিজরতের জন্যে তাদের অনুমতি নিয়ে আস। যদি তারা তোমাকে অনুমতি দেয় তবে জিহাদে গিয়ে শরিক হও। যদি তারা তোমাকে অনুমতি না দেয় তবে তাদের সাথে অবস্থান কর এবং ভালভাবে তাদের সেবা যত্ন কর। (আবু দাউদ, আহমদ)

হিজরত ও জিহাদ আল্লাহ তাআলার কাছে দুটি প্রিয়তম বস্ত্ত। বস্ত্তত, যদি কারও পিতামাতা অসুস্থ কিংবা বৃদ্ধ হয়ে যায় তবে তাকে এমন গুরুত্বপূর্ণ আমল থেকে পর্যন্ত অব্যাহতি দেওয়া হয়। তখন পিতামাতার সেবা করাই তার প্রধান কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় এবং এর ফলে হিজরত ও জিহাদকারীদের সমতুল্য সওয়াব সে প্রাপ্ত হবে। এসব হাদিস থেকে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, যদি কেউ পিতা মাতার বৃদ্ধ বয়সে বা তাদের অসুস্থতার সময় কোন জাগতিক ইচ্ছা কিংবা প্রয়োজনে তাদের উপেক্ষা বা অবহেলা করে তবে সে গুরুতর পাপের অপরাধী বিবেচিত হবে।

অন্যদের পিতামাতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, একটি বড় পাপ হল, কোন ব্যক্তির, তার পিতামাতাকে অভিশাপ দেয়া। তারা জানতে চাইলেন, কেউ কি তার পিতামাতাকে অভিশাপ দেয়? তিনি উত্তর করলেন, কোন ব্যক্তি অন্যের পিতাকে অভিশাপ দেয়। ফলে সেও তার পিতাকে অভিশাপ দেয় এবং সে অন্যের মাকে অভিশাপ দেয়, তখন সেও তার মাকে অভিশাপ দেয়। (বুখারি, মুসলিম)

এটি ইসলামের সৌন্দর্য ও মহত্ত যে, তা কেবল নিজের পিতা মাতাকেই ভালবাসতে ও সম্মান জানাতে শিক্ষা দেয় না, বরং অন্যদের পিতামাতার সাথেও অনুরূপ আচরণ করতে শিক্ষা দেয়।

পিতামাতার অধিকারের তাৎপর্য
হজরত আবু উমামা (রা.) বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করে, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! সন্তানের উপর তাদের পিতামাতার কি অধিকার? তিনি উত্তর দিলেন, তারা তোমার জান্নাত কিংবা জাহান্নাম। (ইবনে মাজাহ)

কোরান মাজিদ বারংবার ঘোষণা করেছে যে, আল্লাহ তাআলার হকের পরেই পিতামাতার হক। যদি আমরা তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করি তবে আল্লাহ তাআলার আদেশেরই আনুগত্য করি। যদি আমরা তাদের অসম্মান করি তবে আমরা আল্লাহর আদেশকেই অমান্য করি। অতঃপর তার ফলে পরিণামস্বরূপ জাহান্নামে যেতে পারি।

বৃদ্ধ বয়সে পিতামাতার প্রতি বিশেষ যত্নবান হওয়া
হজরত আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করে, কে আমার সদ্ব্যবহার পাওয়ার সবচেয়ে বেশি হকদার? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিলেন, তোমার মাতা। লোকটি জিজ্ঞাসা করল, অত:পর কে? তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিলেন, তোমার মাতা। লোকটি পুনরায় জিজ্ঞাসা করল, অত:পর কে? আর তিনি উত্তর দিলেন, তোমার মাতা। লোকটি চতুর্থবারের মত জানতে চাইলে তিনি উত্তর দিলেন, তোমার পিতা। (বুখারি, মুসলিম)

ইসলামে পিতামাতার মর্যাদা আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরেই। বস্ত্তত, মায়ের মর্যাদা পিতার মর্যাদার চেয়ে তিনগুণ বেশি। এই হাদিসের ব্যাখ্যাকারগণ বলেন, তা তিনটি বিশেষ কষ্টের কারণেই যা মাতা তার সন্তানের জন্যে স্বীকার করে থাকেন। যথা: গর্ভধারণ, সন্তান প্রসব ও সন্তানকে দুগ্ধপান করানোর সময়কাল।

বর্ণিত আছে যে, একদা সাহাবী.জারীহকে তার মা ডাকেন, যখন তিনি নামাজরত ছিলেন। কিন্তু, তিনি নামাজ অব্যাহত রাখেন। যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা জানতে পারলেন, তিনি বললেন, যদি জারীহ জানত যে, মায়ের ডাকে সাড়া দেওয়া আল্লাহ তাআলার কাছে নামাজ পড়া থেকেও অধিক গুরুত্বপূর্ণ। (ফতহুল বারী, শরহুল বুখারি)

এই হাদিসের ব্যাখ্যাকারগণ বলেন, এ থেকে কেবল নফল নামাজই উদ্দেশ্য। পক্ষান্তরে যদি পিতামাতা তাদেরকে জরুরী ভিত্তিতে ডাকেন তবে ফরজ নামাজরত থাকলেও তা ভেঙে তাদের ডাকে সাড়া দিতে হবে।

বর্ণিত আছে যে, এক ব্যক্তি তার বৃদ্ধ মাতাকে হারাম শরীফে নিয়ে আসে। সে তাকে তার কাঁধে নিয়ে কাবা শরীফের চারপাশে তাওয়াফ করতে থাকে। সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করল, আমি কি এখন আমার মায়ের প্রতি কর্তব্য পালন করেছি? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে উত্তর দিলেন, তুমি তোমার মায়ের একটি শ্বাসে-প্রশ্বাসের হকও আদায় কর নি। (তাফসীরে ইবনে কাসীর, ৩য় খন্ড)

হজরত মুয়াবিয়া (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এসে ইসলামের জন্যে জিহাদে শরিক অনুমতি চাইল। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তার মা জীবিত আছেন কিনা? যখন লোকটি উত্তরে বলল, হ্যাঁ। রাসূলুল্লাহ বললেন, ফিরে যাও এবং তোমার মায়ের কাছে থাক। কেননা, বেহেশত তার পায়ের নিচে। (আহমদ, বায়হাকি, নাসায়ি)

এই হাদিসটি ছেলেমেয়েকে পিতামাতার কাছে বিশেষত: মায়ের নিকটে থাকার আদেশ প্রদান করে। এটি তাদেরকে আরও বলে যে, তারা যেন তাদের সাধ্য অনুসারে মায়ের সেবা করে। কেননা, মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। ইসলামের এই বুনিয়াদি শিক্ষা মুসলিম সমাজে মাতাগণকে একটি সম্মানজনক ও মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান দান করেছে। পরিবারের সকল সদস্যের কাছে মা তার জীবনের শেষ নি:শ্বাস পর্যন্ত ভালবাসা ও সম্মানের কেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকে। পরিশেষে, পশ্চিমা সমাজও মাতাদের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছে। তারা বছরের একটি দিনকে মা দিবস হিসেবে চিহ্নিত করে তা প্রকাশ করে থাকে। সকল ছেলেমেয়ে একত্রে সেদিন আগমন করে এবং তাদের মায়ের প্রতি তাদের ভালবাসা ও মমতা প্রদর্শন করে। দুর্ভাগ্যবশত, অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব মায়েরা তাদের বৃদ্ধ বয়সে কোন না কোন নার্সিং হোমে জীবন পার করে। পক্ষান্তরে, একজন মুসলিমের জীবনে প্রতিটি দিনই একেকটি মাতৃদিবস এবং তিনি কখনো তার বার্ধক্যকাল নার্সিংহোমে যাপন করেন না।

মায়ের ভগ্নির প্রতি বিশেষ দৃষ্টি
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর কাছে আগমন করল এবং বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমি পাপ করেছি। আমার ক্ষমা পাওয়ার কোন পথ আছে কি? তিনি জানতে চাইলেন, তাঁর মাতা জীবিত আছেন কিনা? যখন লোকটি বলল, না’। তিনি জানতে চাইলেন, তার মাতার ভগ্নি জীবিত আছেন কিনা? যখন লোকটি বলল, হাঁ। তিনি বললেন, তাকে ভালভাবে সেবা যত্ন কর। (তিরমিযি)

এই হাদিসটি আমাদেরকে দুটি বুনিয়াদি বিষয় শিক্ষা দেয়। প্রথমত: যদি কোন ব্যক্তি কোন পাপ কাজ করে বসে এবং এর দ্বারা আল্লাহ তাআলাকে অসন্তুষ্ট করে, সে তার মায়ের সেবা করার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি ফিরে পেতে পারে। দ্বিতীয়ত, যদি তার মাতা মৃত্যুবরণ করে তবে সে তার মায়ের ভগ্নির সেবার মাধ্যমেও আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি ফিরে পেতে পারে।

বারা ইবনে আযিব (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মায়ের ভগ্নি মায়ের সমতুল্য। (তিরমিযি)

একজন অমুসলিম মায়ের প্রতিও দয়া প্রদর্শন
আসমা বিনতে আবু বকর (রা.) বর্ণনা করেন, তার মাতা অমুসলিম অবস্থায় তাকে দেখতে মদীনায় আসেন। তিনি রাসূলুললাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেন, আমার মা অমুসলিম। কিন্তু তিনি আমার কাছে কিছু পেতে আশা করছেন। আমি কি তাকে সন্তুষ্ট করব? তিনি বললেন, হ্যাঁ। মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। (বুখারি, মুসলিম)

আসমা ছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মহিয়সী স্ত্রী আয়েশা (রা.) এর বৈমাত্রেয় বড় বোন। আবু বকর (রা.) মুসলমান হওয়ার পুর্বে তাকে( তার মাকে) তালাক দিয়েছিলেন। সে ইসলাম গ্রহন করেনি এবং হুদায়বিয়ার সন্ধির পর অমুসলিমরা যখন মদীনায় আসার অনুমতি পায়, সে তখন তার মেয়েকে দেখতে মদীনায় আসে। যখন আসমা (রা.) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করেন, তিনি তার মায়ের সাথে কেমন আচরণ করবেন? তিনি তার মায়ের প্রতি সদয় ও বিবেচক হতে নির্দেশ দিলেন, সে একজন অমুসলিম হওয়া সত্ত্বেও।

পিতার মর্যাদা
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহর সন্তুষ্টি পিতার সন্তুষ্টিতে এবং আল্লাহর অসন্তুষ্টি পিতার অসন্তুষ্টিতে নিহিত। (তিরমিযি)

আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেন, আমার এক স্ত্রী ছিল যাকে আমি ভালবাসতাম। কিন্তু, আমার পিতা ওমর তাকে অপছন্দ করতেন। তিনি আমাকে বললেন তাকে তালাক দিতে। কিন্তু আমি তা প্রত্যাখান করি। ওমর (রা.) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে গেলেন এবং এ বিষয়টি তাকে অবহিত করেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে ডাকলেন এবং তাকে তালাক দিয়ে দিতে বললেন। (আবু দাউদ, তিরমিযি)

(বর্ণিত আছে, এরপর তিনি তার স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দেন।)

উল্লেখ্য যে, ইসলামে বিয়ে ও তালাক প্রদানের অধিকারী কেবল স্বামী। (আরও বিস্তারিত জানার জন্যে এই বইয়ের ৩য় অধ্যায় দ্রষ্টব্য।) এমনকি যদি পিতামাতা তাদের ছেলের স্ত্রীদের পছন্দ নাও করেন তবুও তারা ছেলের বউকে তালাক দিতে বাধ্য করতে পারেন না। তবে যেহেতু, ওমর (রা.) ছিলেন একজন বড় ন্যায়বান সাহাবী, তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) কে তার পিতার ইচ্ছার প্রতি সম্মান দেখাতে বলেছেন।

আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কোন ব্যক্তিই তার পিতার হক আদায় করতে পারে না, তবে যদি সে তাকে দাস অবস্থায় পায় এবং (তাকে কিনে) আজাদ করে দেয়। (মুসলিম)

আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, একটি বড় পূণ্য কাজ হল পিতার বন্ধুদের প্রতি সদ্ব্যবহার করা। (মুসলিম)

অন্যত্র তিনি বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তিন প্রকারের দোয়া নিঃসন্দেহে কবুল হয়। পিতার দোয়া (তার সন্তানের জন্যে), (আল্লাহর পথের) মুসাফিরের দোয়া ও মজলুমের দোয়া। (আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ, তিরমিযি)

যদিও ইসলামে মায়ের মর্যাদা পিতার চেয়ে তিনগুণ বেশি, কিন্তু পিতার ভূমিকা ও মর্যাদাকে খাট করে দেখার কোন সুযোগ নেই। এই হাদিস পিতাকে এক স্বতন্ত্র মর্যাদা দান করে এবং বলে যে, সন্তানের জন্যে পিতার দোয়াকে আল্লাহ তাআলা ফিরিয়ে দেন না। অতএব, আমাদের উচিৎ হবে, সাধ্যমত পিতাকে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করা।

মৃত্যুর পরে পিতামাতার অধিকার
আবু ওসাইদ সায়েদী (রা.) বর্ণনা করেন, একদা আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট ছিলাম। এমতাবস্থায় বনু সালমা গোত্রের এক ব্যক্তি তাঁর কাছে এল এবং বলল, হে আল্লাহর রাসূল! পিতামাতার মৃত্যুর পর আমার উপর কি তাদের কোন হক রয়েছে, যা আমাকে পালন করতে হবে? তিনি উত্তর দিলেন, হ্যাঁ। তাদের জন্যে দোয়া করবে। তাদের জন্যে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে। তাদের অঙ্গীকারসমূহ পূর্ণ করবে। তাদের প্রতি সদ্ব্যবহার করবে যারা তাদের কারণে তোমার আত্মীয় হয়েছে এবং তাদের সাথী সঙ্গীদেরকেও সম্মান করবে। (আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ)

ইসলামে পিতামাতার অধিকার এতই স্বতন্ত্র ও গুরুত্বপূর্ণ যে, তা কখনো শেষ হয় না, এমনকি তাদের মৃত্যুর পরও। এই হাদিস আমাদের উপর তাদের মৃত্যু পরবর্তী কিছু অধিকারের কথা তুলে ধরে।

আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, পিতামাতার প্রতি সর্বাধিক উত্তম আনুগত্য হল তাদের মৃতুর পর তাদের সঙ্গী সাথীদের সাথে সদ্ব্যবহার করা।(মুসলিম)

আব্দুল্লাহ ইবনে দীনার বর্ণনা করেন, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) মক্কার পথে এক বেদুঈনের সাক্ষাত পেলেন। তিনি তাকে সালাম দিলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি অমুকের পুত্র অমুক? লোকটি উত্তর করল, হ্যাঁ। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) তাকে তার গাধাটি দিয়ে দিলেন এবং এতে আরোহন করতে বললেন। তিনি তাকে তার পাগড়িটিও দিয়ে দিলেন এবং তা মাথায় পরে নিতে বললেন। তাঁর কিছু সহচর বলল, আল্লাহ আপনার কল্যাণ করুন! সে তো কেবলই একজন বেদুঈন। আর বেদুঈনরা সামান্য বস্ত্ততেই তুষ্ট হয়ে থাকে। আপনি তাকে আপনার গাধা ও পাগড়ি দিয়ে দিলেন? অথচ, এ সবে আপনার নিজেরও প্রয়োজন রয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) উত্তর দিলেন, তার পিতা ছিলেন আমার পিতার বন্ধু এবং আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, একটি বড় পূণ্যের কাজ হল, পিতার বন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের সাথে উত্তম আচরণ করা। (মুসলিম)

যদিও এ হাদিসে কেবল পিতার কথাই উল্লেখ করা হয়েছে এবং যেহেতু, ইসলামে মায়ের মর্যাদা পিতার মর্যাদার তিনগুণ, এ থেকে বুঝা যায়, মায়ের বন্ধ-বান্ধব এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের সাথেও উত্তম আচরণ করা জরম্নরি।

আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রা.) বর্ণনা করেন, সাদ ইবনে আছ (রা.) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেন, আমার মা মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনি (মৃত্যুর পূর্বে) একটি অঙ্গীকার করেছিলেন, যা তার পালন করা উচিৎ ছিল। অথচ তিনি তা করেন নি। উত্তরে তিনি বললে, তার পক্ষ থেকে তুমি তা পালন কর। (বুখারি, মুসলিম)

আনাস ইবনে মালেক (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, প্রায়ই এমনটি হয়ে থাকে যে, কোন ব্যক্তির পিতামাতার একজন কিংবা উভয়েই মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু সে তাদের জীবদ্দশায় যথাযথ সেবা যত্ন করতে পারে নি। এভাবে নিজেকে তাদের সন্তুষ্টি অর্জন থেকে বঞ্চিত করে। অতঃপর সে তার দোয়ার মধ্যে তাদেরকে স্মরণ করে এবং তাদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। তখন আল্লাহ তাআলা তার নাম মাতাপিতার নাফরমানদের তালিকা থেক পরিবর্তন করে অনুগতশীলদের তালিকাভুক্ত করে নেন। (বায়হাকি)

এই হাদিসটি তাদের জন্যে শুভ সংবাদ বহন করে যারা পিতামাতার উভয়কে কিংবা তাদের একজনকে হারিয়েছে। কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না যে, সে তার পিতামাতার প্রতি যথাযথ হক আদায় করেছে। অতএব, আমাদের উচিৎ হবে তাদের জীবদ্দশায় সাধ্যমত তাদের হক আদায় করার চেষ্টা করা এবং মৃত্যুর পরে তাদেরকে আমাদের দোয়ায় স্মরণ করা। তা কেবল তাদের জন্যেই উপকারী হবে না, বরং তাদের জীবদ্দশায় তাদের সেবা যত্ন করার ক্ষেত্রে আমাদের ত্রুটি ও দুর্বলতাকেও মোচন করে দেবে।

পিতামাতার আনুগত্যের পুরষ্কার
আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, পিতামাতার হকের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলার অনুগত হয়ে যে ব্যক্তি ভোরে ঘুম থেকে জেগে ওঠে, প্রভাতে তার জন্যে জান্নাতের দুটি দরজা খুলে যায়। আর যদি কেবল একজন বেচে থাকেন তখন তার জন্যে শুধু একটি দরজা খুলে দেয়া হয়। যে ব্যক্তি পিতা-মাতার হকের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলার অবাধ্য হয় তার জন্যে জাহান্নামের দুটি দরজা উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। আর যদি কেবল একজন বেঁচে থাকেন তবে শুধু একটি দরজাই খুলে দেওয়া হয়। এক ব্যক্তি জানতে চাইল, যদি পিতামাতা তার প্রতি নিষ্ঠুর হয়, তবুও কি এরূপ হবে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিলেন, যদিও পিতামাতা তার প্রতি নিষ্ঠুর হয়। যদিও পিতামাতা তার প্রতি নিষ্ঠুর হয়। যদিও পিতামাতা তার প্রতি নিষ্ঠুর হয়। (বায়হাকি)

যাবের (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যার মধ্যে তিনটি গুণ থাকবে আল্লাহ তাআলা তার মৃত্যুকে সহজ করবেন এবং তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। আর তা হল, দুর্বলদের প্রতি দয়া, পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহার ও দাস-দাসীদের (চাকর চাকরাণীদের) প্রতি ভাল আচরণ। (বায়হাকি)

ছাওবান (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, দোয়া ব্যতিত অন্য কিছুই ভাগ্যকে বদলাতে পারে না এবং পিতামাতার প্রতি সদাচার ব্যতিত অন্য কিছুই আয়ুকে প্রলম্বিত করতে পারে না। কোন ব্যক্তি তার পাপের কারণে তার রিযিক থেকে বঞ্চিত হয়। (ইবনে মাজাহ)

জীবন প্রলম্বিত হওয়া সম্পর্কে বিজ্ঞজনেরা বলেন, এ থেকে উদ্দেশ্য জীবনে সৎকাজের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া, বছরের সংখ্যা বৃদ্ধি নয়। যে ব্যক্তি পিতামাতার অনুগত সে জীবনে ভাল কাজ করার যথেষ্ট সময় ও সুযোগ লাভ করবে। পক্ষান্তরে, যে ব্যক্তি পিতামাতার অবাধ্য হবে সে বিভিন্ন রোগ, শোক, দুঃখ বেদনা ও পেরেশানিতে আক্রান্ত হবে এবং জীবনে ভাল কাজ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে।

আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, পিতামাতার আনুগত্য কর এবং তাদের সাথে সদয় ব্যবহার কর। কেননা, যদি তুমি তেমনটি কর তবে তোমার ছেলেমেয়েরাও তোমার আনুগত্য করবে এবং তোমার সাথে সদয় ব্যবহার করবে। (তাবরানি)

একটি গল্প প্রচলিত আছে, তা সত্য হতে পারে, আবার নাও হতে পারে, তবে তা একটি ভাল বার্তা বহন করে। কথিত আছে, এক ব্যক্তি তার বৃদ্ধ পিতার সেবা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। তাই সে তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিল। একদিন সে তার পিতাকে কাপড়ে মুড়িয়ে একটি কুপের কাছে নিয়ে গেল। যখনই সে তাকে কুপে নিক্ষেপ করার উপক্রম হল, তখন তার পিতা তাকে বলল, তার একটি শেষ ইচ্ছা রয়েছে এবং সে যেন তা পূর্ণ করে। ছেলে তাকে তার শেষ ইচ্ছা সম্পর্কে জানতে চাইলে বলল, তার শেষ ইচ্ছা হল, সে যেন তাকে এই কুপে নিক্ষেপ না করে অন্য কোন কুপে নিক্ষেপ করে। ছেলে তার এ ইচ্ছার কথা শুনে বিস্মিত হয়ে কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। উত্তরে পিতা বলল, সে তার পিতাকে ইতোপূর্বে এই কুপটিতে নিক্ষেপ করেছিল। ছেলে এ থেকে একটি বার্তা পেল এবং তৎক্ষণাৎ পিতাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে গেল। আর আমৃত্যু ভালভাবে তার সেবা যত্ন করল।

আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি নিদ্রামগ্ন ছিলাম এবং স্বপ্নে দেখতে পেলাম যে, আমি বেহেস্তে প্রবেশ করেছি। তাতে কাউকে কোরান তেলাওয়াত করতে শুনলাম এবং আমি জানতে চাইলাম, আল্লাহর কোন বান্দা বেহেস্তের মধ্যে কোরান তেলাওয়াত করছে? আমাকে বলা হল, তিনি হচ্ছেন হারিছা ইবনে নুমান। পরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হারিছা ইবনে নুমান তার মায়ের খুব অনুগত ছিল এবং তার খুব সেবা যত্ন করত। (বায়হাকি)

পিতামাতার অবাধ্যতার পরিণাম
আবু বারকাহ নুফাই ইবনে হারিছ (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমি কি তোমাকে বলব, কবীরা গুনাহ কি কি? তিনি একথাটি তিনবার পুনরাবৃত্তি করলেন। আমি বললাম, অবশ্যই, হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন, আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করা, পিতামাতার অবাধ্য হওয়া। বর্ণনাকারী বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি বালিশে হেলান দেয়া ছিলেন। কিন্তু তিনি হঠাৎ সোজা হয়ে বসলেন এবং বললেন, এবং মিথ্যা কথা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া। তিনি বাক্যটি এত বেশি পরিমাণে পুনরাবৃত্তি করলেন যে, আমরা আশা করছিলাম, তিনি যদি থেমে যেতেন। (বুখারি)

আনাস ইবনে মালেক (রা.) বর্ণনা করেন, কেউ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামক কবীরা গুনাহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি উত্তরে বলেন, আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করা, পিতামাতার অবাধ্য হওয়া ও তাদের কষ্ট দেওয়া, অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা এবং মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া। (বুখারি)

উপরোক্ত হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবীরা গুনাহর বর্ণনা দেওয়ার ক্ষেত্রে যে ক্রমধারা অবলম্বন করেছেন তা লক্ষ্যণীয়। পিতামাতার সাথে নাফরমানী করার অপরাধ গুরুত্বের বিচারে আল্লাহর সাথে শিরক করার পরে এবং তা অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা এবং মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া থেকেও অধিক গুরুতর।

মুগীরা ইবনে শুবা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তাআলা তোমাদের উপর হারাম করেছেন মাদের অবাধ্য হতে, কৃপণতা, মিথ্যা অপবাদ ও কন্যা সন্তানকে জীবিত কবর দেওয়া থেকে। আর তিনি তোমাদেরকে বারণ করেছেন, অবান্তর কথাবার্তা, অত্যধিক জিজ্ঞাসা ও অপচয় থেকে। (বুখারি, মুসলিম)

পিতামাতার অবাধ্যতার শাস্তি
আবু বারকাহ (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তাআলা ইচ্ছা করলে সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিতে পারেন, পিতামাতার নাফরমানী ব্যতিত। আর তিনি পিতামাতার অবাধ্যতার শাস্তি মৃত্যুর পূর্বে দুনিয়াতেই দিয়ে দেন। (বায়হাকি)

তিনটি বিশেষ ঘটনা
যাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত। এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে আগমন করেন এবং তার পিতার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, আমার পিতা আমার সম্পদ নিয়ে যেতে চান। তিনি বললেন, তোমার পিতাকে নিয়ে আস। এমন সময়ই জিবরাইল আগমন করলেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, তার পিতা আসলে আপনি তাকে জিজ্ঞাসা করবেন, ঐ বাক্যগুলো কি, যেগুলো সে মনে মনে বলেছে এবং স্বয়ং তার কানও শুনতে পায় নি। যখন লোকটি তার পিতাকে নিয়ে হাজির হল, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ব্যাপার কি, আপনার পুত্র আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ করল কেন? আপনি কি তার আসবাবপত্র ছিনিয়ে নিতে চান? পিতা বলল, আপনি তাকে এ প্রশ্ন করুন, আমি তার ফুফু, খালা ও নিজের জীবন রক্ষার প্রয়োজন ব্যতিত তা কোথায় ব্যয় করি? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ব্যাস! অভিযোগ ব্যাখ্যার জন্যে এতটুকুই যথেষ্ট। এরপর তার পিতাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ঐ বাক্যগুলো কি, যেগুলো এখন পর্যন্ত স্বয়ং আপনার কানও শোনেনি? ইয়া রাসূলুল্লাহ! প্রত্যেক ব্যাপারেই আল্লাহ তাআলা আপনার প্রতি আমাদের ঈমানকে বৃদ্ধি করে দিন। (যে কথা কেউ শুনেনি তা আপনার জানা হয়ে গেছে। এটা একটা মুজিজা। অতঃপর সে বলল, এটা ঠিক যে, আমি মনে মনে কয়েক লাইন কবিতা বলেছিলাম, যেগুলো আমার কানও শুনে নি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কবিতাগুলো আমাকে শুনান। তখন সে নিম্নোক্ত পংক্তিগুলো আবৃত্তি করল, আমি শৈশবে তোমাকে খাবারের ব্যবস্থা করেছি এবং যৌবনেও তোমার দায়িত্ব বহন করেছি। তোমার যাবতীয় খাওয়া-পরা আমারই উপার্জন থেকে ছিল। কোন রাতে যখন তুমি অসুস্থ হয়ে পড়েছ, তখন আমি সারা রাত জেগে কাটিয়েছি। যেন তোমার রোগ আমাকেই স্পর্শ করেছে, তোমাকে নয়। ফলে সারা রাত আমি ক্রন্দন করেছি। আমার অন্তর তোমার মৃত্যুর ভয়ে ভীত হত; অথচ আমি জানতাম যে, মৃত্যুর জন্য দিন নির্দিষ্ট রয়েছে- আগে পিছে হতে পারবে না। অতঃপর যখন তুমি বয়ঃপ্রাপ্ত হয়েছ এবং আমার আকাঙ্খিত বয়সের সীমা পর্যন্ত পৌঁছে গেছ, তখন তুমি কঠোরতা ও রুঢ় ভাষাকে আমার প্রতিদান করে দিয়েছ, যদি তুমি আমার প্রতি অনুগ্রহ ও কৃপা না করতে, আফসোস! যদি তোমার দ্বারা আমার পিতৃত্বের হক আদায় না হয়, তবে কমপক্ষে ততটুকুই করতে যতটুকু একজন ভদ্র প্রতিবেশী তার প্রতিবেশীর সাথে করে থাকে। তুমি কমপক্ষে আমাকে প্রতিবেশীর হক তো দিতে এবং আমার সম্পদে আমার সাথে কৃপণতা না করতে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবিতাগুলো শুনার পর ছেলের জামার কলার চেপে ধরলেন এবং বললেন, যাও, তুমি ও তোমার সম্পদ সবই তোমার পিতার। (তাফসীরে কুরতুবী, ৬:২৪)

আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিম্নোক্ত ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন:

একদা তিন ব্যক্তি পথিমধ্যে বৃষ্টিতে আক্রান্ত হওয়ায় একটি পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় গ্রহণ করল। একটি পাথর গড়িয়ে এসে গুহার মুখকে সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দিলে তিন ব্যক্তিই গর্তের মধ্যে আটকা পড়ে গেল। তারা পরস্পর পরস্পরকে বলল, চল, আমরা আমাদের এমন কোন পূণ্য কাজের কথা স্মরণ করি যা আমরা একান্তভাবে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্য করেছি এবং তার উসীলায় আল্লাহর কাছে দোয়া করি যেন তিনি গর্ত থেকে পাথরটি সরিয়ে দেন। তাদের একজন বলল, হে আল্লাহ! আমার বৃদ্ধ ও দুর্বল পিতামাতা রয়েছে এবং ছোট ছেলেমেয়েও আছে। যাদের জন্য আমি ভেড়া পালন করি। যখন আমি রাতের বেলা ঘরে ফিরি প্রথমে পিতামাতাকেই আমি দুগ্ধ পান করতে দেই এবং অতঃপর ছেলেমেয়েকে দেই। একদিন আমি রাতের বেলা দেরীতে ঘরে ফিরে পিতামাতা উভয়কেই নিদ্রিত অবস্থায় পেলাম। আমি অন্যদিনের মত দুধ নিয়ে তাদের কাছে গেলাম এবং তাদের নিকটে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমি তাদেরকে ঘুম থেকে জাগানো পছন্দ করলাম না এবং এও চাইলাম না যে, প্রথমে আমার ছেলেমেয়েকে দুধ পান করতে দেব। যদিও আমার ছেলেমেয়েরা ক্ষুধার তাড়নায় কান্নাকাটি করছিল। আমি ভোর হওয়া পর্যন্ত তাদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। হে আল্লাহ! যদি আমি এই কাজটি আপনার সন্তুষ্টি লাভের জন্য করে থাকি তবে আমাদের উপর থেকে পাথরটিকে সরিয়ে দিন। এতে আল্লাহ তাআলা গর্তের উপর থেকে পাথরটিকে কিছুটা সরিয়ে দিলেন।

দ্বিতীয় লোকটি বলল, সে তার এক চাচাত বোনকে ভালবাসত এবং সে তার সাথে পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। যখন সে (চাচাত বোন) তাকে আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দিল সে পাপাচারে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত থাকল। অতঃপর সে দোয়া করে বলল, হে আল্লাহ! যদি আমি এই কাজটি কেবল আপনার সন্তুষ্টির জন্যে করে থাকি তবে গর্তের উপর থেকে পাথরটিকে সরিয়ে দিন। আল্লাহ তাআলা তার দুআ কবুল করেন এবং পাথরটি গর্তের মুখ থেকে আরও কিছুটা সরে গেল।

তৃতীয় ব্যক্তি বলল, সে এক লোকের সাথে একটি অংশীদারী কারবার করত। লোকটি অন্যত্র চলে গেলে সে একাই তা দেখাশুনা করতে থাকে এবং তার অংশীদারের অংশের হিসাব রাখত। যখন অংশীদার ফিরে এল সে তার অংশ লাভসহ বুঝিয়ে দিল। অতঃপর সে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বলল, হে আল্লাহ! যদি আমি এই কাজ কেবলমাত্র আপনার সন্তুষ্টির জন্য করে থাকি, আপনি এর উসীলায় গর্তের মুখ থেকে পাথরটি সরিয়ে দিন। আল্লাহ তাআলা তার প্রার্থনা কবুল করলেন এবং গর্তের মুখ সস্পূর্ণরূপে উন্মুক্ত হয়ে গেল। আর তারা তা থেকে বের হয়ে আসতে সক্ষম হলো। (বুখারি, মুসলিম)

আব্দুল্লাহ ইবনে ওবাই (রা.) বর্ণনা করেন সাহাবী আলকামা নামাজ রোজার ক্ষেত্রে খুবই নিয়মানুবর্তী ছিলেন। যখন তার মৃত্যু নিকটবর্তী হল, লোকেরা তাকে কালেমার তালকীন করলেন। কিন্তু, তিনি তা পড়তে সমর্থ হলেন না। এই অবস্থা তার স্ত্রী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জানানোর জন্যে লোক পাঠালেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তার পিতামাতা বেঁচে আছেন কিনা। তাঁকে জানানো হল, আলকামার মা বেঁচে আছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাকে ডেকে পাঠালেন। তিনি অতি দ্রম্নত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসে হাজির হলেন। তিনি আলকামা সম্পর্কে তার মতামত জানতে চাইলেন। তিনি বললেন, সে একজন দীনদার লোক। তবে তার উপর স্ত্রীকে বেশি প্রাধান্য দেয় এবং তাকে অমান্য করে। তাই তিনি তার উপর অসন্তুষ্ট। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ক্ষমা করে দিতে বললেন। কিন্তু তিনি তাতে সম্মত হলেন না। তিনি তখন বেলাল (রা.)-কে কাঠ সংগ্রহ করে আগুন জ্বালিয়ে জ্বলন্ত আগুনে আলকামাকে নিক্ষেপ করতে বললেন। মা একথা শুনে খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি বাস্তবিকই আলকামাকে আগুনে পোড়াতে ইচ্ছুক কিনা? তিনি তখন বললেন, হ্যাঁ, আল্লাহ তাআলার শাস্তি এই শাস্তি থেকেও অনেক কঠিন। আল্লাহর কসম! আপনি যতক্ষণ আপনার ছেলের উপর অসন্তুষ্ট থাকবেন, তার না কোন নামাজ আল্লাহর কাছে কবুল হবে আর না কোন দান। আলকামার মা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি আপনাকে এবং উপস্থিত সকলকে সাক্ষী রেখে বলছি, আমি আলকামাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন আলকামার অবস্থা দেখার জন্যে কাউকে তার কাছে পাঠালেন। তখন সে এই সুসংবাদ নিয়ে ফিরে এল যে, আলকামা কালেমা পাঠ করে মৃত্যুবরণ করেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং তার জানাজায় গেলেন এবং বললেন, মুহাজির ও আনসারদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি তার মায়ের অবাধ্য হবে কিংবা তাকে অসন্তুষ্ট করবে, তার উপর আল্লাহ, তাঁর ফেরেস্তা ও সকল মানুষের অভিসম্পাত বর্ষিত হবে। আল্লাহ তাআলা তার কোন কাজ কিংবা নফল ইবাদত কবুল করবেন না, যতক্ষণ না সে অনুশোচিত হবে, মায়ের যথাযথ পরিচর্যা ও সেবা করবে এবং তাকে সন্তুষ্ট করবে।’ (তাবরানি)

এই হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুহাজির ও আনসারদের সম্বোধন করেছেন। কেননা, তখন তার আশেপাশে কেবল তারাই ছিলেন। অধিকন্তু, তিনি কেবল মায়ের কথা উল্লেখ করেছেন। কেননা, ঘটনাটি মায়ের সন্তুষ্টির সাথে সম্পর্কিত ছিল। যা হোক, এটি পরিষ্কার যে, এই নির্দেশনাটি সকল মুমিনের জন্যে এবং পিতামাতা উভয়ের সন্তুষ্টির কথা বলে, বিশেষতঃ মায়ের। আমাদের জেনে রাখা উচিৎ যে, আলকামা ছিলেন খুব ধার্মিপরায়ন ব্যক্তি লোক এবং তার নামাজ রোজার ব্যাপারে খুবই নিয়মানুবর্তী। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একজন সাহাবীও ছিলেন। এসব কিছুই মৃত্যুর সময় তাকে সাহায্য করতে পারে নি। তিনি মৃত্যুর সময় কালিমা শাহাদাত পাঠের নিয়ামত থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলেন কেবল তার মাকে অসন্তুষ্ট করার কারণে। আমাদের সেই হাদিসও স্মরণ রাখতে হবে যাতে এসেছে, যে ব্যক্তি এ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে যে, তার শেষ কথা হবে কালেমা, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। কেউ বলতে পারে না কখন মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসবে। অতএব, আমাদেরকে শীঘ্রই আমাদের মাতা পিতার, বিশেষ করে মায়ের সন্তুষ্টি কামনা করতে হবে। অন্যথায় আমরাও মৃত্যুর সময় কালেমা পাঠের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হব।

Post a Comment

 
Top